পারকিনসন’স ডিজিজ এবং সচেতনতা
নিউজ ডেস্ক
|
ডাঃ মুশফিকুল হক । প্রভাষক, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ। পারকিনসন’স ডিজিজঃ কাল্পনিক একটি ঘটনা বলি, ছোট বেলার ঐকিক নিয়মে অংকের মত রহিম সাহেব কে দিয়েই বলি। রহিম সাহেব অনেক বছর সরকারি চাকুরি করার পর রিটায়ার করলেন। ভাবলেন, অনেক বছর কষ্ট করেছি, এবার আর কাজ না, সারাদিন শুধু বাসায় আরাম করব, খাব দাব ঘুমাব। তার হার্টের রোগ ও নাই, ডায়বেটিস ও নাই। তাই খাওয়া দাওয়ায় কোন বাধাও নাই। এভাবে ভালই চলছে। ৬ মাস পর ব্যাংক এ টাকা তুলতে গিয়ে হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলেন স্বাক্ষর করতে গেলে তার হাত কাপছে। গুরুত্ব দিলেন না। ভাবলেন হয়ত শরীর দূর্বল। এভাবে কিছুদিন কেটে গেল। ধীরে ধীরে সমস্যা বাড়তে থাকল বিধায় ডাক্তার দেখাতে বাধ্য হলেন। ধরা পড়ল পারকিনসন’স ডিজিজ। মনের জোর ছিল ভাবলেন হয়ত ঔষধ খেলে ভাল হয়ে যাবেন। কিন্তু আস্তে আস্তে অবস্থা খারাপের দিকেই যেতে থাকল। আগে হাত কাপতো, এখন সাড়া শরীর কাপে; হাটতে গেলে পড়ে যান; শরীরের উপর কোন নিয়ন্ত্রন নাই। প্রতিবেলায় ৫-৬ টা বড়িই এখন জিবনের সঙ্গী। কিভাবে ভাল হবেন, কোথায় যাবেন, কোন ডাক্তার দেখাবেন, কিছুই বুঝে পান না। নিউরোমেডিসিন বিশেষজ্ঞ দেখান, উনি গেলেই ঔষধ বাড়িয়ে দেন, সেগুলা খেলে মাথা ঘুড়ায়, কিছুই করতে পারেন না। ধীরে ধীরে ১০ বছর পার হয়ে গেল। পরিবারের লোকজন ছাড়া বাইরের কাউকে বোঝানোও যায়না কি সমস্যা তার, কারন মানুষ এর ধারনা একমাত্র স্ট্রোক করলেই এমন হতে পারে, উনি তো স্ট্রোক করেন নাই। খেতে পারে, স্মৃতি শক্তি ঠিক আছে, তাহলে তো কোন সমস্যাই নাই। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কতটা যন্ত্রনা নিয়ে উনি বেচে আছেন এটা কারো বোধগম্য নয়। সারাক্ষন তার মনে দুশ্চিন্তা বিরাজ করে, নানান রকম শব্দ শুনেন, ভয়াবহ দুঃসপ্ন দেখেন, সবই ঔষধ এর পার্শপ্রতিক্রিয়া; সেই ঔষধ না খেয়েও উপায় নাই। এভাবে তার মানসিক স্বাস্থ্য ভেংগে পড়ে, স্বাভাবিক জীবন থেকে দূরে সরে যান অনেক; সারাক্ষন একটা ভয় আতংক নিয়ে বেচে থাকেন। পরিবারের লোকজন বাইরের কাউকে এগুলা নিয়ে কিছু বলেন না। কারন মানসিক স্বাস্থ্য এখনো আমাদের দেশে একটা ট্যাবু। মানুষ শুধু বুঝে পাগল হয়ে গেছে; মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবে কেন এমন হয় এটা কেউ বুঝার চেষ্টা করেন না। হার্ট এর সমস্যা নাই, ডায়বেটিস নাই তাহলে আর অস্বুস্থ্য কেমনে! এটাই সবার কথা। হার্টে ব্লক, ডায়বেটিস, ক্রিয়েটিনিন বেশি, লিভারে চর্বি, শরীরে জয়েন্টে ব্যাথা, রাতে ঘুম হয়না ইত্যাদি নিয়েই আমাদের দেশের মানুষদের খুব বেশি ভাবতে দেখা যায়। কিছু রোগ আছে যেসব এ আক্রান্ত হলে বেশিরভাগ রোগী জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত অবহেলাতেই রয়ে যায়, কারন না তার পরিবার তার এই রোগের ধরন সম্পর্কে কোন ধারনা রাখে, না তার ডাক্তার তাকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারে, না তার রোগের উন্নত চিকিৎসা এই দেশে হয়! এমনই একটি রোগ পারকিনসন’স রোগ। মস্তিষ্ক এবং স্নায়ু তন্ত্রের অত্যন্ত জটিল এই রোগ ক্রমশ শরীরের চালিকা শক্তি কে কমিয়ে দিতে থাকে। মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের মধ্যে ক্রমশ ক্ষয় হতে থাকে যার ফলে শরীরের স্বাভাবিক ভারসাম্য রক্ষা করে চলাফেরা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। সামান্য শার্টের বোতাম লাগানো তখন সেই রোগীর জন্য অসাধ্য একটি কাজ মনে হয়, যা সে অন্যের সাহায্য ছাড়া করতে পারেন না। এই রোগের চিকিৎসা প্রধানত “লেভোডোপা” নামক একটি ঔষধ। এটাই তার শরীরের ভারসাম্যে রক্ষা করতে সাহায্য করে। এছাড়া আরো বিভিন্ন ঔষধ রোগীর বিভিন্ন প্রয়োজনে দেওয়া হয়ে থাকে। যত দিন বাড়তে থাকে রোগীর মাংসপেশী শক্ত হতে থাকে যাকে মেডিকেলের ভাষায় বলা হয় স্টিফনেস। সেই জন্য দরকার বিশেষায়িত ফিজিও থেরাপীর ব্যবস্থা। এই রোগের জন্য বিশেষ ফিজিও থেরাপি সেন্টার আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। বেশীরভাগ হাসপাতালে এই রোগীকে কিভাবে সেবা দিতে হবে তার সম্পর্কে নূন্যতম জ্ঞান নেই স্বাস্থ্যকর্মীদের। রোগীর শরীর যেন ভেংগে না পড়ে, শরীরের শক্তি যেন বজায় রাখা যায় সেই ব্যাপারে সাহায্য করবে এমন কোন বিশেষ ক্লিনিক নেই যারা রোগীর শরীরের চাহিদা মত তার জন্য বিশেষ সেবার ব্যবস্থা করবে; হতে পারে তা কোন ওয়াকার যা ধরে উনি হাটবেন, হতে পারে তা কোন বিশেষ চেহার যেখানে উনি বসবেন ইত্যাদি। এই রোগের রোগীরে সবচেয়ে বেশি যেই সমস্যাতে ভুগেন তা হল অতি ঔষধ সেবন। দেখা যায় রোগীর অভিযোগ অনুযায়ী অনেক ঔষধ তাকে দেওয়া হয় যা দীর্ঘ সময় সেবন করলে তার নানা রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। এই ক্ষেত্রে ডাক্তার এবং রোগীর আত্মীয় উভয়কেই সচেতন থাকতে হবে যেন অকারনে অতি ঔষধ এর প্রয়োগ না করা হয়। অতি ঔষধ প্রয়োগ এর কারনে সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যার একটি হল সাইকোসিস। এই সাইকোসিস দুটি কারনে হতে পারে। দীর্ঘদিন পারকিনসন’স এ আক্রান্ত ব্যাক্তির রোগের শেষ পর্যায় হিসাবে সাইকোসিস দেখা দিতে পারে। আবার বিভিন্ন রকম ঔষধ এর পার্শপ্রতিক্রিয়া হিসাবেই এটি দেখা দিতে পারে যা বেশীরভাগ সময় ঘটে থাকে। এখন সবার মনে প্রশ্ন জাগবে সাইকোসিস কি? সাইকোসিস হল মানসিক রোগের মত উপসর্গ দেখা দেওয়া। সাধারনত কোন মানসিক রোগের উপসর্গ যদি অন্য কোন রোগ, বা অন্য কোন কারন থেকে উৎপত্তি হয় তাহলে সেটাকে সাইকোসিস বলা হয়। যেমন কন ব্যক্তি মানসিক ভাবে সুস্থ্য, কিন্তু কোন নেশাজাতীয় দ্রব্য পান করার পর কিছু সময়ের জন্য সে মানসিক রোগীর উপসর্গ প্রকাশ করে; সেই অবস্থা কে আমরা বলব সাইকোসিস। তেমনিভাবে, পারকিনসন’স কোন মানসিক রোগ না; এটি একটি মস্তিষ্কের রোগ। কিন্তু এই মস্তিষ্কের রোগ এর শেষ পর্যায়ে অথবা তার মস্তিষ্ক কে ঠিক রাখতে প্রয়োগকৃত কোন ঔষধ এর পার্শপ্রতিক্রিয়া হিসাবে যদি মানসিক রোগের উপসর্গ দেখা যায় তখন আমরা এটাকে পারকিনসন’স সাইকোসিস বলে থাকি। এটি এই রোগের এমন একটি পর্যায় যখন এই রোগীর সেবা করা সবচেয়ে কঠিন হয়ে পড়ে। উপসর্গ গুলো হল অবাস্তব বস্তু দেখা বা শুনা, বা গন্ধ পাওয়া, যাকে আমরা হেলুসিনেশন বলি। যেমন রোগি বলবেন, আমি দেখতে পাচ্ছি জানালার বাইরে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে; কিন্তু বাস্তবে স্বুস্থ্য মানুষ দেখতে পাবে কেউ নেই। অথবা উনি শব্দ শুনবেন কেউ তাকে গুলি করেছে; শুনবেন মাইকে সারাক্ষন কে যেন কথা বলছে। এসব হল হেলুসিনেশন। দ্বিতীয় যে সমস্যা হবে সেটা হল ডিলিউশন বা ভুল বিশ্বাস। এই ক্ষেত্রে অবাস্তব বস্তু দেখার পাশাপাশি তিনি অবাস্তব বিষয় বিশ্বাস করবেন। তিনি ভাববেন কাছেন কেউ তার ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। হয়ত তিনি ভাববেন দেশের প্রেসিডেন্ট তাকে ফোন করে কথা বলছেন, তিনি ভাববেন খুব গুরুত্বপূর্ন কেউ একজন তার সাথে দেখা করার জন্য বাসার নীচে এসেছেন, তাই তিনি বার বার বাইরে যেতে চাইবেন। তাকে হয়ত কেউ একজন বলেছে গোসল করতে, তাই উনি বার বার গোসল করতে চাইবেন; রোগীর সেবাদানকারী ব্যক্তির জন্য তখন খুবই কঠিন হয়ে পড়ে তাকে সামাল দেওয়া। এরকম পরিস্থিতিতে সাধারনত পরিবারের লোকজন ভেঙ্গে পড়েন। কারন তারা এর কোন সমাধান খুজে পান না। এই ক্ষেত্রে সাধারন মানসিক রোগের যেসব ঔষধ আছে তা এই রোগীকে দেওয়া যায়না। তাই এই ক্ষেত্রে ঔষধ নির্বাচন করা খুব সাবধানতার সাথে করতে হয়। দেখা যায় সাধারন মানসিক রোগের জন্য যেসব ঔষধ দেওয়া হয় যেমন, হ্যালপেরিডল, ক্লোরপ্রোমাজিন, লোক্সাপিন এই ধরনের ঔষধ যদি প্রয়োগ করা হয় তাহলে তার অবস্থার ব্যাপক অবনতি ঘটতে পারে। এই ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, সেই সাথে রোগীর পরিজনদেরও এই বিষয়ে সচেতনতা অর্জন করতে হবে যেন কোন ভুল ঔষধ রোগীকে না খাওানো হয়। পারকিনসন’স রোগীর মানসিক উপসর্গ দেখা দিলে যে ঔষধ গুলো তাকে দেওয়া যাবে সেগুলো হল ক্লোজাপিন, কোয়াইটাপিন, ওলানজাপিন। তাছাড়া উন্নত দেশসমূহে নতুন একটি ঔষধ প্রচলিত হয়েছে যা এখনো আমাদের দেশে যথাযথভাবে প্রয়োগ হয়না, তা হল পিমাভ্যানসেরিন। তবে এই নতুন ঔষধ নিয়ে এখনো গবেষনা চলছে। দেখা গেছে, পারকিনসন’স এর সকল ধরনের মানসিক উপসর্গ এই ঔষধ দূর করতে পারেনা। তবে খেয়াল রাখতে হবে, এসব ঔষধ যেন খুবই সাবধানতার সাথে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শেই প্রয়োগ করা হয়। তবে এই ক্ষেত্রে ঔষধ সকল সমস্যার সমাধান নয়। মূলত দেখা যায় বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ঔষধ তার সমস্যা পুরোপুরি দূর করতে পারেনা এবং সমস্যা থেকেই যায়, এবং এই সমস্যা নিয়েই তিনি বাকী জীবন পার করেন। এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যেই বিষয়টি প্রয়োজন তা হল সচেতনতা। রোগীর পরিজনদের মনে রাখতে হবে যে রোগী যে অবাস্তব বস্তু দেখেন বা শোনেন, তা রোগীর কাছে দিনের আলোর মত বাস্তব মনে হয়। সুতরাং তার এসব হেলুসিনেশন ভুল সেটা তাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা যাবেনা। তার হ্যাঁ এর সাথে হ্যাঁ মিলাতে হবে। তার যে অবাস্তব বিশ্বাস সেগুলা ভাংগানোর চেষ্টা করা যাবেনা। সে যদি বলে আমাকে মারার জন্য ডাকাত আসছে, তাহলে আপনি বলবেন, আচ্ছা আমি নীচে যাচ্ছি, দেখে আসছি, অথবা আমি ব্যাবস্থা নিয়েছি যাতে তারা আসতে না পারে। কিন্তু যদি আপনি বলেন, ধুর, তুমি এসব কি দেখ এগুলা সত্যি না, ঘুমাও তো!! তাহলে সে আপনাকেও অবিশ্বাস করা শুরু করবে, কারন মনে রাখবেন তার মনে এগুলোই সত্য। এটাকে আপনি জোর করে পরিবর্তন করতে পারবেন না। আপনাকে ধৈর্য সহকারে এগুলা সামাল দিতে হবে। এটাকে নিয়েই বেচে থাকতে হবে। সর্বোপরি, আমাদের দেশে এই রোগের সম্পর্কে সচেতনতা ডাক্তার এবং সাধারন মানুষ উভয় শ্রেনীর মাঝেই কম। ডাক্তারদের উচিৎ এর সম্পর্কে আরো জ্ঞান অর্জন করা, আর সাধারন মানুষের উচিৎ নিজের প্রিয়জনের রোগ সম্পর্কে ধারনা রাখা। এই রোগের সম্পর্কিত বিশেষায়িত শিক্ষা আরো বাড়ানো প্রয়োজন। নিউরোসাইকিয়াট্রি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রীর প্রচলন করা প্রয়োজন যা এই রোগ নিয়ে কাজ করে। যার বাড়ীতে এমন রোগী আছে তার উচিৎ ধৈর্য সহকারে তার রোগীর সেবা করা, সবসময় চেষ্টা করা যেন সে আরাম পায়, তার কোন কষ্ট না হয়। সবার উচিৎ নিজে সচেতন হওয়া এবং অন্যকে সচেতন করা; মানসিক উপসর্গ দেখা দিলেই তাকে পাগল বা মাথা খারাপ এই ধরনের কথা না বলে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অর্জন করা। সর্বোপরি অত্যন্ত নিষ্ঠা এবং সাবধানতার সাথে তার চিকিৎসার ব্যাবস্থা করা।
|
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |