বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪ ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অকৃত্রিম বন্ধুর দায়িত্ব পালন করেন সায়মন ড্রিং
নিউজ ডেস্ক:
প্রকাশ: বুধবার, ২১ জুলাই ২০২১, ০২:৩৮ রাত | অনলাইন সংস্করণ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অকৃত্রিম বন্ধুর দায়িত্ব পালন করেন সায়মন ড্রিং। সে সময়ে গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী প্রথম বিদেশি সাংবাদিক তিনি। নিজের জীবন বিপন্ন করে ঢাকা শহর ঘুরে সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরি করে সারাবিশ্বকে সায়মন ড্রিং জানিয়ে দেন পাকিস্তানি বাহিনীর লোমহর্ষক নির্যাতন ও গণহত্যার কথা। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যাযজ্ঞ শুরু করার আগেই ঢাকায় সে সময় অবস্থানরত সব বিদেশি সাংবাদিককে একটি হোটেলে অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়। সেনা কর্তৃপক্ষ তাঁদের বলে, শহরের পরিস্থিতি খুব খারাপ, নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁদের হোটেলের ভেতরেই অবস্থান করতে হবে। অবরুদ্ধ বিদেশি সাংবাদিকেরা সারা রাত গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান, কেউ কেউ জানালা দিয়ে দেখতে পান আগুন। পরদিন সকালেই তাঁদের বিমানবন্দরে নিয়ে তুলে দেওয়া হয় উড়োজাহাজে। কিন্তু সায়মন ড্রিং প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে হোটেলেই লুকিয়ে ছিলেন। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ সায়মন ড্রিংকে খুঁজে পায়নি। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ ওঠে গেলে হোটেলের কর্মচারীদের সহযোগিতায় ছোট্ট একটি মোটরভ্যানে করে ঘুরে ঘুরে দেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা। ২৭ মার্চ তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করে ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রতিবেদন আকারে পাঠান, যা ‘ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’ শিরোনামে ৩০ মার্চ প্রকাশ হয়। তার এ প্রতিবেদন বিশ্বে ব্যাপক সাড়া জাগায়। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনমত সৃষ্টিতে তার এ প্রতিবেদন অনেক বড় ভূমিকা রাখে। ওই প্রতিবেদনে তিনি লিখেন, “আল্লাহর নামে আর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও সন্ত্রস্ত এক নগরী। পাকিস্তানি সেনাদের ঠান্ডা মাথায় টানা ২৪ ঘণ্টা গোলাবর্ষণের পর এ নগরের…।” অখণ্ড পাকিস্তানের স্বপ্নে বিভোর পাকিস্তানী বর্বর সেনারা ঠাণ্ডা মাথায় নৃশংসভাবে খুন করেছে সাধারণ মানুষদের। ১৯৭১-এর মার্চে ঢাকায় নিজের অভিজ্ঞতা এভাবেই ব্যক্ত করেছেন ব্রিটিশ সাংবাদিক সায়মন জন ড্রিং। তিনি আজও ভুলতে পারেননি ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতার কথা। পাক-সাঁজোয়া বাহিনী কীভাবে ঢাকাসহ গোটা পূর্ব পাকিস্তানকে ঠাণ্ডা মাথায় মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করেছিল সেটাই উঠে এসেছে তার লেখায়। ড্রিং নিজেই এক রাতে ৭ হাজার মানুষ জবাইয়ের ঘটনার সাক্ষী। নৃশংসতার মাধ্যমে পাকিস্তান একটি দেশের স্বাধীনতার স্বপ্নকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। পাক সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান বিশ্ববাসীর কাছে গোপন করার চেষ্টা করেছিলেন ঢাকার প্রকৃত ছবিটা। কিন্তু ড্রিং সাহসিকতার সঙ্গে সেদিন তুলে ধরেছিলেন পাকিস্তানি বর্বরতার ছবি। তার লেখায় উঠে আসে গণহত্যার বিবরণ। সায়মন ড্রিংয়ের বিবরণ অনুযায়ী, পাকসেনারা ঢাকায় সবচেয়ে বড় আঘাত হানে ছাত্রদের ওপর। পদাতিক, সাঁজোয়া ও গোলন্দাজ এ তিন পাকিস্তানি ব্যাটালিয়ান রাত ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে ব্যারাক থেকে বেরিয়ে পড়ে ঢাকা আক্রমণে। শুরু হয় গোলাবর্ষণ। নির্মম অত্যাচারে মেতে ওঠে পাকসেনারা। বঙ্গবন্ধুকে আগেই টেলিফোনে সতর্ক করা হয়েছিল। তাকে আত্মগোপন করার পরামর্শ দেয়া হলেও তিনি তা করেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে না পেলে ওরা ঢাকা শহরকে তছনছ করে ছাড়বে।’ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত এম-২৪ ট্যাংক নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকসেনাদের হামলার বিবরণ তুলে ধরেছেন ড্রিং। মাঝরাতে ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরির সামনে থেকে শুরু হয় শেলিং। ইকবাল হলেই দু’শরও বেশি শিক্ষার্থী মারা যান। ছাত্রদের ওপর মেশিনগান থেকে চলতে থাকে গুলি বৃষ্টি। দু’দিন পরও লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেছে সেখানে। গণকবর দিয়ে তার উপর চালিয়ে দেয়া হয় ট্যাংক। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই নয়, আশপাশের দু’শ গজ এলাকাজুড়ে চলে সেনা সন্ত্রাস। পাকিস্তানি সেনার আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পায়নি মসজিদও। ঢাকা মেডিকেল কলেজেও ব্যাপক গুলিবৃষ্টি হয়। পাক বর্বরতার প্রকৃত ছবি ঘটনার দু’দিন পর বাড়ির বাইরে বের হয়ে ঢাকার মানুষ দেখতে পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরই পাকসেনাদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইন। ড্রিংয়ের বিবরণ অনুযায়ী, প্রথমে ট্যাংক থেকে শুরু হয় শেলিং। তারপর ঘুমন্ত অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ কর্মীদের হত্যা করা হয়। ১ হাজার ১০০ পুলিশকর্মী ছিলেন সেখানে। খুব কমসংখ্যকই সেদিন প্রাণ হাতে পালাতে পেরেছিলেন। ১৯৭১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার সায়মন ড্রিংকে জোরপূর্বক দেশ থেকে বের করে দেয়। ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে পুনরায় নভেম্বর, ১৯৭১ সালে কলকাতায় আসেন তিনি। সেখান থেকে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর নিরপেক্ষভাবে ঐ দৈনিকে পাঠাতে থাকেন। ১৬ ডিসেম্বর তারিখে বিজয়ের দিনে যৌথবাহিনীর সঙ্গে ফের ঢাকায় আসেন সায়মন ড্রিং। তলপেটে সার্জারি চলাকালে গত শুক্রবার (১৬ জুলাই) লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন এই প্রথিতযশা সাংবাদিক। বাংলাদেশ হারালো তার অকৃত্রিম বন্ধুকে। ইংল্যান্ডের নরফোকের ফাকেনহাম নামক এক ছোট্ট শহরে ১১ জানুয়ারি ১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন সায়মন ড্রিং। ১৭ বছর বয়সে তিনি প্রথম চাকরিতে যোগদান করেন। ১৯৬৩ সালে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক ওয়ার্ল্ড সংবাদপত্রে ‘প্রুফ রিডার’ (সম্পাদনা সহকারী) হিসেবে কাজ করেন। তারপর ১৯৬৪ সালে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমসে কাজ শুরু করেন। একই বছর ভিয়েতনাম থেকে তিনি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের যুদ্ধবিষয়ক সংবাদ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি রয়টার্সের সর্বকনিষ্ঠ বৈদেশিক সংবাদদাতা হিসেবে নিজে ইতিহাসে ঠাঁই করে নেন। ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ এই সময়ে সায়মন ড্রিং ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকা এবং বিবিসি টেলিভিশন নিউজের বৈদেশিক সংবাদদাতা হিসেবে সারা পৃথিবী চষে বেড়ান। ঐ সময়ে তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে প্রতিবেদন পাঠাতেন। ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, লাতিন আমেরিকা এবং ইউরোপের অস্থিতিশীল ঘটনাপ্রবাহ নিয়মিত তুলে ধরতেন সংবাদ মাধ্যমগুলোয়। পেশাগত জীবনে ২২টি যুদ্ধ ও অভ্যুত্থান কাভার করেছেন। ইরানের শাহবিরোধী গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে প্রতিবেদন তৈরী করে সায়মন ড্রিং নন্দিত হয়েছিলেন এবং অর্জন করেছিলেন অনেক পুরস্কার। সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি দু’বার আহতও হয়েছিলেন। প্রথমবার ভিয়েতনামে এবং দ্বিতীয়বার সাইপ্রাসে তুর্কিদের আগ্রাসনে। বিবিসি রেডিও এবং টেলিভিশনে কাজ করার পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে লিখেছেন তিনি। ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের গণহত্যার ওপর প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদন তাকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি ও সুনাম এনে দেয়। রাজনীতি/জিএস
« পূর্ববর্তী সংবাদ পরবর্তী সংবাদ »






সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত

এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ