সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর লিখিত বক্তব্য
নিউজ ডেস্ক:
|
নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ৭৬তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশগ্রহণ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার বিকেল চারটার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও গণভবনে ভিডিও কনফারেন্সে এ সংবাদ সম্মেলন শুরু হয়। গণভবনে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ও দলের নেতারা এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর পূর্ণাঙ্গ লিখিত বক্তব্য তুলে ধরা হলো-
আসসালামু আলাইকুম। শুভ অপরাহ্ন।
আপনারা জানেন যে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে অংশ নিতে গত ১৯ সেপ্টেম্বর আমি নিউইয়র্কে যাই।
মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী, মাননীয় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা আমার সফরসঙ্গী ছিলেন। করােনা মহামারি শুরু হওয়ার প্রায় দুই বছর পর এবারই প্রথম আমি দেশের বাইরে সশরীরে কোনাে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যােগদান করি। নিউইয়র্কে অবস্থানকালে আমার অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনের মূল সভা ও সাইড ইভেন্ট মিলিয়ে আমি সর্বমােট ১০টি সভা এবং ৮টি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অংশ নেই। এছাড়া ৭৬তম অধিবেশনের সাধারণ বিতর্ক পর্বের উদ্বোধনী দিনেও আমি যােগদান করি।
কোভিড-১৯ মহামারির প্রেক্ষাপটে ‘প্রত্যাশা’কে উপজীব্য করে এবারের অধিবেশনে আলােচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল মহামারি থেকে টেকসই উত্তরণ। এছাড়া কোভিড-১৯ টিকার সার্বজনীন প্রাপ্যতা, সহজলভ্যতা ও মহামারি থেকে টেকসই পুনরুদ্ধার স্বভাবতই আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে।
পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন, নারীর ক্ষমতায়ন, সমতা ও অন্তর্ভুক্তি, বর্ণবাদ, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট তথা এসডিজি, পারমাণবিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ ইত্যাদি বিষয়গুলােও আলােচনায় উঠে এসেছে।
সফরের প্রথম দিনে ২০ সেপ্টেম্বর ইউএন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সল্যুশন নেটওয়ার্কের (এসডিএসএন) পক্ষ থেকে ২০১৫-২০২০ সময়কালে এসডিজি অর্জনে সর্বোচ্চ সাফল্যের জন্য আমাকে এসডিজি প্রগ্রেস অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। এসডিএসএন’র প্রেসিডেন্ট প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রফেসর জেফ্রি স্যাক্স আমার হাতে এই সম্মাননাটি তুলে দেন। কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশ যে অবিচলভাবে টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট অর্জনে এগিয়ে যাচ্ছে, এই পুরস্কার তারই বিশ্ব স্বীকৃতি। আমি আমার ধন্যবাদ জ্ঞাপন বক্তব্যে দেশের জনগণকে এই পুরস্কার উৎসর্গ করি।
এই সফরের একটি বিশেষ আকর্ষণ ছিল জাতিসংঘ সদরদপ্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে একটি স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন এবং একটি শতবর্ষী বৃক্ষ রােপণ। উল্লেখ্য, জাতিসংঘের সদর দপ্তর চত্বরে কোনো রাজনৈতিক নেতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের এ ধরনের উদ্যোগ এটিই প্রথম। বাংলাদেশের জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি বিরল সম্মাননা।
২৪ সেপ্টেম্বর আমি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাধারণ বিতর্ক পর্বে বক্তব্য রাখি। প্রতিবারের মতো এবারও আমি বাংলায়
এছাড়া আমি কোভিড-১৯ মহামারির কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলাের ক্ষতি কমানাে, ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলাের কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, ক্ষতিপূরণ প্রদান, টেকসই অভিযােজনের জন্য অর্থায়ন ও প্রযুক্তির অবাধ হস্তান্তরের অনুরােধ করি। পাশাপাশি ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম এবং ভালনারেবল-২০ গ্রুপ অফ মিনিস্টারস্ অফ ফাইন্যান্স-এর সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশের ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা- দশক ২০৩০’-এর কার্যক্রম সম্পর্কে আমি বিশ্বনেতৃবৃন্দকে অবহিত করি।
পাশাপাশি চলমান মহামারির প্রকোপে শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা ও টেকসই পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ডিজিটাল সরঞ্জামাদি ও সেবা, ইন্টারনেটের সুযােগ-সুবিধার সহজলভ্যতা ও শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়ােগের প্রয়ােজনীয়তা উল্লেখপূর্বক আমি জাতিসংঘকে অংশীদারত্ব ও প্রয়ােজনীয় সম্পদ নিশ্চিত করার জন্য অনুরােধ জানাই।
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণে বাংলাদেশের সাফল্য তুলে ধরে উন্নয়ন সহযােগীদের প্রতি একটি প্রণােদনাভিত্তিক উত্তরণ কাঠামাে প্রণয়নের প্রস্তাব করি। অভিবাসীগ্রহণকারী দেশগুলােকে অভিবাসীদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার, তাদের কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য এবং কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য আহ্বান জানাই। রােহিঙ্গা সংকট সম্পর্কে আমি আবারও বিশ্বনেতৃবৃন্দকে স্মরণ করিয়ে দেই যে, রােহিঙ্গা সংকটের সৃষ্টি মিয়ানমারে, সমাধানও রয়েছে মিয়ানমারে। রাখাইন রাজ্যে তাদের মাতৃভূমিতে নিরাপদ, টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের মাধ্যমেই কেবল এ সংকটের স্থায়ী সমাধান হতে পারে বলে উল্লেখ করে আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ বিষয়ে গঠনমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করার অনুরােধ জানাই।
কপ২৬-কে সামনে রেখে এবারের অধিবেশনের অন্যতম আলােচিত বিষয় ছিল জলবায়ু পরিবর্তন ও তার বিরূপ প্রভাব মােকাবিলা।
জাতিসংঘ মহাসচিব ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর যৌথ উদ্যোগে জলবায়ু বিষয়ে সােচ্চার কয়েকটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানগণের অংশগ্রহণে ২০ সেপ্টেম্বর একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সােচ্চার অন্যতম দেশের সরকারপ্রধান এবং সিভিএফ-এর সভাপতি হিসেবে আমাকে এ সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানাে হয়। এ সভায় অংশ নিয়ে আমি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মােকাবিলায় নতুন আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলােতে সবুজ প্রযুক্তির অবাধ হস্তান্তরের পক্ষে বক্তব্য প্রদান করি। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত লস অ্যান্ড ড্যামেজ এবং জলবায়ুজনিত কারণে বাস্তচ্যুত জনগণের পুনর্বাসনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কর্তৃক কার্যকর ভূমিকা পালনেরও আহ্বান জানাই।
২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ৭৬তম অধিবেশনের সভাপতি আব্দুল্লাহ্ শহীদের আমন্ত্রণে আমি বিশ্বের নারী নেতৃবৃন্দের
এছাড়া ২১ সেপ্টেম্বর আমি ইউএস-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিলের আয়ােজনে একটি গােলটেবিল বৈঠকে
সাধারণ অধিবেশনের সাইডলাইনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমন্ত্রণে ২২ সেপ্টেম্বর আমি কোভিড়-১৯ বিষয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের সভায় অংশগ্রহণ করে চলমান মহামারি মােকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ এবং সাফল্যগুলাে তুলে ধরি।
সাধারণ অধিবেশনের সাইডলাইনে ইউরােপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, সৌদি আরব, ওআইসি, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, গাম্বিয়া এবং বাংলাদেশের যৌথ আয়ােজনে ২২ সেপ্টেম্বর রােহিঙ্গা সমস্যা বিষয়ক একটি উচ্চপর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় আমি মূল বক্তব্য প্রদান করি। এ অনুষ্ঠানে তুরস্ক, গাম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং হাঙ্গেরির পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যুক্তরাজ্যের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিগণ এবং আসিয়ানের স্পেশাল এনভয় বক্তব্য দেন। রােহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের সৃষ্টি এবং এর সমাধানও রয়েছে মিয়ানমারে উল্লেখ করে আমি কয়েকটি বিষয়ের উপর জোর দেওয়ার আহ্বান জানাই।
এর মধ্যে রয়েছে:
ক. প্রত্যাবাসনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে এ লক্ষ্যে সকল কার্যক্রম পরিচালিত করা;
২৩ সেপ্টেম্বর স্পেন, কোস্টারিকা ও সিয়েরা লিওনের প্রেসিডেন্ট এবং সুইডেনের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে সমতা ও অন্তর্ভুক্তি
এবারের অধিবেশনের কোভিড-১৯ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বিশ্ববাসীর জন্য খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের বিষয়টিও প্রাধান্য পায়। আমি ২৩ সেপ্টেম্বর এ সংক্রান্ত আয়ােজিত ইউনাইটেড নেশনস ফুড সিস্টেম সামিট- ২০২১ শীর্ষক একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে অংশগ্রহণ করে খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনে বাংলাদেশের সফলতাগুলাে তুলে ধরি। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ মােকাবিলা এবং টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে প্রযুক্তির হস্তান্তরের জন্য একটি বিশেষ তহবিল গঠনেরও আহ্বান জানাই।
এবারের অধিবেশন চলাকালে আমি বেশ কয়েকটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অংশ নেই। এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল- বার্বাডােজের প্রধানমন্ত্রী মিয়া আমার মােতেলি, সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন লোফভেন, কুয়েতের প্রধানমন্ত্রী শেখ সাবাহ খালেদ আল-হামাদ আল সাবাহ, জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি, মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ভিয়েতনামের রাষ্ট্রপতি নিউয়ান জুয়ান ফুক এবং নেদারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক। এসব দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অংশ নিয়ে আমি পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলােচনা করার পাশাপাশি রােহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনােযােগ ও সহযােগিতা কামনা করি।
এছাড়া নিউইয়র্ক সফরকালে ২৪ সেপ্টেম্বর আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী প্রবাসী বাংলাদেশীগণের একটি সম্বর্ধনা
এবারের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের মূল বিষয়গুলাে বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক ছিল। বিশেষত কোভিড-১৯ টিকার সর্বজনীন প্রাপ্যতা ও মহামারি থেকে টেকসই পুনরুদ্ধার সংক্রান্ত শীর্ষ সভাসমূহে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা অন্যতম দেশ ও ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের সভাপতি হিসেবে জলবায়ু সংক্রান্ত সভাগুলােতে অংশগ্রহণ করে আমরা আমাদের দাবিগুলাে জোরালােভাবে তুলে ধরেছি। পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অগ্রগতির কথাও বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করেছি যা সব মহলে বহুল
এবারের অধিবেশনে রােহিঙ্গা সমস্যা ও এর স্থায়ী সমাধানের বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলােচিত হয়, যা রােহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখবে বলে আমি আশা করি।
৭৬তম অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের সক্রিয় অংশগ্রহণ বহুপাক্ষিক ফোরামে বাংলাদেশের অবস্থান যেমন সুদৃঢ় করেছে, তেমনি বাংলাদেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহে আন্তর্জাতিক সহযােগিতার ক্ষেত্রকে বিস্তৃত করবে বলে আমি আশাবাদী।
২৫ সেপ্টেম্বর আমি নিউইয়র্ক থেকে ওয়াশিংটন ডিসিতে যাই। ২৯ সেপ্টেম্বর মেরিল্যান্ডে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি বিজড়িত বাংলাদেশ হাউস উদ্বোধন করে একটি বৃক্ষরােপণ করি। ৩০ সেপ্টেম্বর রওনা হয়ে ১ অক্টোবর বাংলাদেশ বিমান যােগে রাতে দেশে ফিরে আসি। |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |