আজ মহাঅষ্টমী, রাজধানীতে হচ্ছে না কুমারী পূজা
নিউজ ডেস্ক:
|
আজ বুধবার মহাষ্টমী। বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকানুযায়ী আজ সকাল ৬টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে দুর্গাদেবীর মহাষ্টম্যাদি বিহিত পূজা শুরু হয়। এদিন সকাল ৮টা ১৪ মিনিট থেকে ৯টা ২ মিনিটের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় সন্ধিপূজা। মা দুর্গার অনেক রূপের মধ্যে একটি রূপ হলো মহিষাসুর-মর্দিনী। মা দুর্গার এই রূপেই তিনি অসুর নিধন করেছিলেন। দুর্গাপূজার পিছনে বেশ কিছু অসুর বধের কাহিনী রয়েছে। যার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে সন্ধিপূজার। অষ্টমী শেষ হয়ে যখন নবমী তিথি শুরু হয় তখনই সন্ধিপূজা করা হয়। আসলে সন্ধিপূজা হলো সন্ধ্যার প্রতীক। অষ্টমী তিথি শেষ হয়ে যাওয়ার শেষ ২৪ মিনিট এবং নবমী তিথি শুরু হওয়ার প্রথম ২৪ মিনিটকে বলে সন্ধিক্ষণ। এই সময়েই দেবী দুর্গা চণ্ড ও মুণ্ড নামে দুই ভয়ঙ্কর অসুরদের নিধন করেছিলেন। এই ঘটনাটিকে স্মরণ করার জন্যই প্রতি বছর অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে এই সন্ধিপূজা করা হয়। সন্ধিপূজার অন্যতম উল্লেখযোগ্য নৈবেদ্য হলো পদ্ম। এই পূজায় দেবীকে ১০৮টি পদ্ম অর্পণ করা হয়, ১০৮টি বেলপাতা এবং ১০৮টি মাটির প্রদীপ জ্বালানো হয়। নৈবেদ্যয় দেওয়া হয় গোটা ফল, জবা ফুল, সাদা চাল, শাড়ি, গহনা এবং সাজ-সজ্জার দ্রব্যও থাকে। এ ছাড়া মহাষ্টমীতে অনুষ্ঠিত হয় কুমারী পূজা। দেবী পুরাণে কুমারী পূজার সুষ্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনসহ কয়েকটি স্থানে প্রতি বছর কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। তবে গত বছরের মতো এ বছর করোনা সংক্রমণের কারণে হচ্ছে না কুমারী পূজা। সিলেটের বাহুবল উপজেলার জয়পুর গ্রামে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মাতুলালয় শ্রীশ্রী শচীঅঙ্গন ধামে আজ অনুষ্ঠিত হবে কুমারী পূজা। এ ছাড়া এই মন্দিরে প্রতিদিনই থাকছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। গতকাল থেকেই মণ্ডপে মণ্ডপে প্রতিমা দর্শনে ভিড় করেছেন ভক্ত ও দর্শনার্থীরা। আজ অষ্টমীতে ভক্ত দর্শনার্থীর ভিড় আরো বাড়বে। মণ্ডপে মণ্ডপে হবে আরতি। আর থাকবে আলোর ঝলকানি। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাতে পূজার এবং প্রতিমা দর্শনের কাজটি ভক্ত দর্শনার্থীরা সম্পন্ন করেন সেই দিকেই বিশেষ নজর দিচ্ছেন আয়োজকরা। ‘পুতুল পূজা করে না হিন্দু কাঠ মাটি দিয়ে গড়া, মৃন্ময়ী মাঝে চিন্ময়ী হেরে হয়ে যাই আত্মহারা’। আমেরিকার বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দ মূর্তিপূজার প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘হিন্দুরা মূর্তিপূজক নন, তারা আদর্শের পূজারি। মূর্তি হলো একটি আদর্শের প্রতীক। সত্যের প্রতীক।’ গতকাল মঙ্গলবার দুর্গোৎসবের মহা সপ্তমীর সকালে চক্ষুদানের মাধ্যমে প্রতিমায় করা হয় প্রাণ প্রতিষ্ঠা। মৃন্ময়ী প্রতিমা ভক্তদের কাছে হয়ে ওঠেন চিন্ময়ী। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, ঈশ্বর সর্ব ভূতে বিরাজিত। অতএব, মূর্তি বা প্রতিমার মধ্যেও বিরাজিত। অর্থাৎ এর মধ্যে যে ঈশ্বর বাস করেন, হিন্দু আসলে তারই পূজা করেন, মূর্তিকে পূজা করেন না। পূজার শুরুতেই গতকাল দেবী দুর্গার প্রতিবিম্ব আয়নায় ফেলে বিশেষ ধর্মীয় রীতিতে স্নান করানো হয়। শুধু মহাসপ্তমীই নয়, মহাষ্টমী ও মহানবমীর দিনও পূজার মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগে মহাস্নান অনুষ্ঠিত হয়। দেবী দুর্গার প্রতিমার সামনে একটি আয়না রেখে সেখানে প্রতিফলিত প্রতিমার প্রতিবিম্বে বিভিন্ন জিনিস দিয়ে মহাস্নান করানো হয়। এর মধ্যে রয়েছে শুদ্ধজল, নদীর জল, শঙ্খজল, গঙ্গাজল, উষ্ণ জল, সুগন্ধি জল, পঞ্চগব্য, কুশ ঘাসের দ্বারা ছিটানো জল, ফুলে দ্বারা ছিটানো জল, ফলের জল, মধু, দুধ, নারকেলের জল, আখের রস, তিল তেল, বিষ্ণু তেল, শিশিরের জল, রাজদ্বারের মাটি, চৌমাথার মাটি, বৃষশৃঙ্গমৃত্তিকা, গজদন্ত মৃত্তিকা, বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকা, নদীর দুই তীরের মাটি, গঙ্গামাটি, সব তীর্থের মাটি, সাগরের জল, ঔষধি মেশানো জল, বৃষ্টিজল, সরস্বতী নদীর জল, পদ্মের রেণু মেশানো জল, ঝরনার জল প্রভৃতি। বলা হয়ে থাকে এই সব রীতি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজের কৃষিসম্পদ, খনিজসম্পদ, বনজসম্পদ, জলজসম্পদ, প্রাণিজসম্পদ, ভূমিসম্পদ প্রভৃতি রক্ষা করার জন্য সাধারণ মানসে বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়। নৈতিকতা স্থাপনে সর্বভূতে দেবীরই অধিষ্ঠানস্বরূপ পতিতোধ্বারের ভাবটিও ফুটিয়ে তোলা এই মহাস্নানের উদ্দেশ্য। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশ নেয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্ব সংহতি ও বিশ্বের কাছে এক অসাম্প্রদায়িক সম্প্রদায়ের সমন্বয়বার্তা দেওয়া হয়। এ ছাড়া করা হয় নবপত্রিকা স্থাপন। যার আরেকটি নাম হলো কলাবৌ স্নান। বেল-তুলসী, আসন, বস্ত্র, নৈবেদ্য, পুষ্পমাল্য, চন্দনসহ ১৬টি উপাচারে দেবী দুর্গাকে পূজা করা হয়। শাস্ত্র অনুযায়ী, নবপত্রিকা মানে ৯টি গাছ। মূলত এটা কলাগাছ তার সঙ্গে থাকে কচু, বেল, হরিদ্রা (হলুদ), দাড়িম্ব (দাড়িম), অশোক, মান জয়ন্তী এবং ধান গাছ। নবপত্রিকার ৯টি গাছ আসলে দেবী দুর্গার নয়টি বিশেষ রূপের প্রতীকস্বরূপ। কলাগাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ব্রহ্মাণী, কচুগাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কালিকা, হরিদ্রা গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী উমা, জয়ন্তী গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কার্ত্তিকী, বিল্ব গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শিবা, দাড়িম্ব গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী রক্তদন্তিকা, অশোক গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শোকরহিতা, মান গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী চামুন্ডা ও ধান গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। আর উনারা সবাই নবদুর্গা রূপে পূজিত হয়। এরপর করা হয় ত্রিনয়নী দেবী দুর্গার চক্ষুদান। চক্ষুদানের মধ্যদিয়ে ত্রিনয়নী দেবী দুর্গার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। শাস্ত্র মেনে চক্ষুদানের সময় কাপড় দিয়ে প্রতিমা ঢেকে ফেলা হয়। কুশ ও কাজল দিয়ে চক্ষুদান করা হয়। কুশের অগ্রভাবে কাজল দিয়ে দেবীর চক্ষুদান করা হয়। এই চক্ষুদানের ক্ষেত্রেও রয়েছে বিশেষ বিধান। ত্রিনেত্র (তিন চোখ) যুক্ত দেব-দেবীর ক্ষেত্রে সবার আগে উপরের নেত্রের চক্ষুদান করা হয়। এরপর দেবীর বাম চোখ ও পরে ডান চোখে চক্ষুদান করা হয়। দেবতার ক্ষেত্রে ডান চোখের পর বাম চোখে চক্ষুদান করা হয়। হিন্দু পুরাণ মতে, মহাসপ্তমীতে ভক্তদের কল্যাণ ও শান্তির আশীর্বাদ নিয়ে হিমালয় কন্যা দেবী দুর্গা পূজার পিঁড়িতে বসেন। পূজা শেষে হাতের মুঠোয় ফুল, বেলপাতা নিয়ে ভক্তরা মন্ত্র উচ্চারণের মধ্য দিয়ে এবারের পূজার প্রথম অঞ্জলি দেন দেবীর পায়ে। করজোরে কাতরকণ্ঠে জগজ্জননীর কাছে করোনা মুক্ত বিশ্বের প্রার্থনা করেছেন ভক্তরা। ঢাকের বাদ্য, কাঁসর ঘণ্টা কিংবা শঙ্খধ্বনিতে দেবীর আরাধনার পাশাপাশি সবেতেই যেন ছিল একই আর্তি। গতকাল ঢাকা রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনে ‘কোভিড-১৯’ সংক্রান্ত নির্দেশনা অনুসরণ করে দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছে। পূজা শুরু হয় সকাল ৬টা ৪৫মি.। অসংখ্য ভক্ত দেবীর চরণে পুষ্পাঞ্জলি দেন। দুপুরে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব ভক্ত ও দর্শনার্থীদের মাঝে খিচুড়ি প্রসাদ বিতরণ করা হয়। বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা পূজা পরিদর্শন করেন। |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |