শিক্ষার সর্বনাশের জন্য রাষ্ট্র দায়ীঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
নিউজ ডেস্ক:
প্রকাশ: রবিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১২:১৬ রাত | অনলাইন সংস্করণ
|
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। লেখক, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক। দীর্ঘকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। বিভাগটির ইমেরিটাস অধ্যাপক। মার্কসবাদী চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ এবং ‘নতুন দিগন্ত’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। শিক্ষায় অবদানের জন্য তিনি ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হন। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুল, নটর ডেম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইংরেজি সাহিত্যে উচ্চতর গবেষণা করেছেন যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয় ও লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষা হবে সর্বজনীন। শিক্ষা হবে সহজলভ্য। শিক্ষা কোনো পণ্য হতে পারে না। এটি হবে সব স্তরের মানুষের অধিকার। কিন্তু বাংলাদেশ হওয়ার পর শিক্ষা ক্রমাগতভাবে পণ্যের দিকে এগিয়ে গেলো সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আমাদের উচ্চশিক্ষাকে আলাদা করে দেখার তেমন সুযোগ আছে বলে মনে করি না। আমরা গোড়ায় নষ্ট করে ফেলেছি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তিন ধারায় বিভক্ত হয়ে গেলো। এই বিভক্তি কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। ব্রিটিশ আমলে দুর্বল অবস্থায় এই বিভক্তি ছিল। পাকিস্তান আমলে কিছুটা ছিল বটে। কিন্তু বাংলাদেশ হওয়ার পর বিভক্তিটা একেবারে শক্ত অবস্থায় চলে আসে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল বিভাজন বা বৈষম্যের শিক্ষাব্যবস্থা থাকবে না। সমস্ত শিক্ষা মাতৃভাষার মাধ্যমে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা ঘটলো না। তিন ধারা আরও শক্তিশালী হলো। তিনটি ধারা স্বতন্ত্রভাবে দাঁড়িয়ে গেলো শ্রেণি বিভাজনের উপরে। আর এই বিভক্তির শিক্ষা শ্রেণি বিভাজনকে আরও গভীর করে তুললো। কাঙ্ক্ষিত ছিল বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে, যেখানে সমাজিতান্ত্রিক অভিমুখে এগিয়ে যাবে। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা উল্টো কাজটি করলো। ফলে সমাজের যে ক্ষতি হলো তা নয়, শিক্ষারও দারুণ ক্ষতি হলো। মাতৃভাষার মাধ্যমে না হলে শিক্ষার গভীরতা থাকে না। এমন শিক্ষা স্থায়ী হতে পারে না এবং সৃষ্টিশীল হতে পারে না। অর্থাৎ, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাব্যস্থা গড়ে তুলতে না পারায় শ্রেণি বিভাজন বাড়লো এবং বিভিন্ন ধারায় শিক্ষাব্যবস্থা নিজেই বিভক্ত হয়ে গেলো। আমরা একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলাম না। এটিই হচ্ছে আমাদের ব্যর্থতা। আমি রাষ্ট্রকে দায়ী করবো। শিক্ষার সর্বনাশের জন্য রাষ্ট্র দায়ী। শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হবে, তা রাষ্ট্রকে নির্ধারণ করতে হয়। এগুলো তো ব্যক্তি বা সংগঠন করতে পারে না। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে আমরা রাষ্ট্র চেয়েছিলাম। এমন রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি ছিল মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তা আর হয়নি। আমরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনাই গড়ে তুলতে পারিনি। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার মধ্যে বাণিজ্য ঢুকে গেলো। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ছিল অল্প। আমরা মনে করেছিলাম বাংলাদেশ হওয়ার পর এই বাণিজ্য একেবারেই থাকবে না। শিক্ষা হবে সর্বজনীন। শিক্ষা হবে সহজলভ্য। শিক্ষা কোনো পণ্য হতে পারে না। এটি হবে সব স্তরের মানুষের অধিকার। কিন্তু বাংলাদেশ হওয়ার পর শিক্ষা ক্রমাগতভাবে পণ্যের দিকে এগিয়ে গেলো। শিক্ষা পণ্য হওয়ার কারণে শুরুতেই নকল গুরুত্ব পেতে থাকলো। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক মিলে এই অসৎ পন্থায় এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হলো। নকলের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হলো না। শিক্ষা অর্জনে ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেলো। না জেনে, না পড়ে ডিগ্রি নিতে থাকলো। শিক্ষার মান নিয়ে কেউ ভাবছি না। না রাষ্ট্র, না ব্যক্তি। বাংলাদেশ হওয়ার পর শিক্ষা মূলত পরীক্ষানির্ভর হয়ে উঠলো। শিক্ষার মানের অবনতির জন্য এই পরীক্ষা ব্যবস্থাও দায়ী। এখন আর শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী পাওয়া যায় না, পরীক্ষার্থী পাওয়া যায়। শিক্ষা অর্জন না করে পরীক্ষায় কীভাবে ভালো করবে! শিক্ষার হতাশার দিক ঠিক এখানেই। অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন লোকের সংখ্যা বেড়েছে। এটি অবশ্যই সফলতার একটি দিক। এখানে শিক্ষাকে মানুষ খুব গুরুত্ব দেয়। সমাজ শিক্ষাকে জীবিকার মাধ্যম জেনেছে। এ কারণে পিতা-মাতা সন্তানের প্রধান কাজ হিসেবে শিক্ষাকেই জানেন। বাংলাদেশে শিক্ষা বিস্তারে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে। নারী শিক্ষায় বাংলাদেশে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে নারী শিক্ষার এমন বিস্তার ছিল না। কল্পনাও করা যেত না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। পাবলিক বিশ্ব বিদ্যালয়ের সংখ্যা না বাড়লেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরিপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় বলার সুযোগ নেই। সেই অর্থে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনেকটাই পরিপূর্ণ। যে ধারায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হয়, তাতে উচ্চশিক্ষার ক্ষতিই হয়েছে বটে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবিক শিক্ষা, এমনকি বিজ্ঞান শিক্ষারও গুরুত্ব দেওয়া হয় না। সেখানে বাণিজ্যিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এখানে গবেষণা নেই। দর্শন, ইতিহাস নিয়ে আলোচনা নেই। বাজারে কোন বিষয়ের চাহিদা আছে, তার উপরেই পড়ানো হয়। এখানে মুনাফা অর্জজনই মুখ্য। তবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কিছুটা ঘাটতি তো পূরণ করছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সীমিত। অনেকেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায় না। তাদের জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উপকারে আসছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় না থাকলে অনেকেই দেশের বাইরে চলে যেত। যদিও এখনো অনেকেই যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষার যে চাহিদা, তা অনেকটাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পূরণ করতে সক্ষম হচ্ছে। তবে এখানকার মান নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন তোলা যায় এবং তুলতে হবে। আগে যে সংকট ছিল, তা এখন আরও প্রকট হয়েছে। সর্বত্র মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা অর্জন না করার সংকট। এটি আরও তীব্র হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ভালো শিক্ষকের সংকট। এই সংকট আরও বাড়ছে। মেধাবীরা এ পেশায় আসছে না। শিক্ষকদের মর্যাদা নেই। বেতন-ভাতায় সংকট। শিক্ষকদের সম্মান না দিয়ে তো আপনি শিক্ষিত জাতি গড়ে তুলতে পারবেন না। এ পেশায় এলে সম্মান পাওয়া যাবে, এটি নিশ্চিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন। শিক্ষার সঙ্গে জীবিকার যে সম্পর্ক, তা জীবন্ত সম্পর্ক না। কিন্তু এখন তাই করা হচ্ছে। শিক্ষিত যুবকরা যখন বেকার থাকছে, এর সঙ্গে জীবিকার প্রশ্ন আসছে। জীবিকার জন্যই শুধু শিক্ষকতা করলে তা খুব সম্মানের হয় না। শিক্ষকরা কীভাবে সম্মান পেতে পারে তার জন্য ভাবতে হবে।
নিউজ ডেস্ক | দৈনিক আজবাংলা
|
ই-মেইল: ajbanglaonline@gmail.com
বাড়ি#৩৫/১০, রোড#১১, শেখেরটেক, ঢাকা ১২০৭