শিশু ও নবজাতকের রোগবালাই এবং লক্ষণ
নিউজ ডেস্ক:
প্রকাশ: সোমবার, ১৫ আগস্ট ২০২২, ০২:৪৬ রাত | অনলাইন সংস্করণ
|
মাতৃগর্ভের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছেড়ে নবীণ আগন্তুক যখন সুতীব্র চিৎকারে তার আগমনী বার্তা জানান দেয় এই পৃথিবীকে, তখন মা-বাবা, পরিবার এবং আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে যেমন এক অনাবিল আনন্দের মুহূর্তের সূত্রপাত হয়, ঠিক তেমনি প্রতিটি পদে পদে চলতে থাকে নবজাতক নিয়ে দুঃশ্চিন্তা। এই বুঝি সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুটির কোন সমস্যা হয়ে গেল! সাধারণত হাসপাতালে শিশু প্রসব হলে সেখানে শিশু চিকিৎসক নবজাতককে দেখে থাকেন এবং অসুস্থ মনে হলে ভর্তি করানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে সুস্থ সবল নবজাতকদের মধ্যেও নানা ধরণের উপসর্গ আসতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এগুলো অসুখের পর্যায়ে পড়ে না, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। তাই এইসব উপসর্গের ব্যাপারে বিজ্ঞানসম্মত ধারণা থাকা প্রয়োজন। প্রথমেই আসি কোন কোন ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরূরি সে প্রসঙ্গে। ১. নবজাতকের শ্বাসকষ্ট নিচের তিনটি লক্ষণের এক বা একাধিক লক্ষ্মণ যদি থাকে- ক. প্রতি মিনিটে শ্বাসের গতি ৬০ বা তার বেশি খ. শ্বাস নেওয়ার সময় বুকের নিচের অংশ গভীর ভাবে দেবে যাওয়া গ. শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে শব্দ হওয়া। ২. যদি প্রথম ৪৮ ঘন্টার মধ্যে শিশুর জন্ডিস দেখা দেয়। নবজাতকের জন্ডিসের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে সেগুলো হলো - মায়ের রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ এবং শিশুর রক্তের গ্রুপ পজিটিভ হলে। মায়ের রক্তের গ্রুপ ও পজিটিভ এবং শিশুর রক্তের গ্রুপ এ কিংবা বি পজিটিভ- এসব ক্ষেত্রে শিশুর মাত্রাতিরিক্ত জন্ডিস হতে পারে। ৩. যদি শিশু বুকের দুধ টেনে খেতে না পারে এবং নিস্তেজ হয়ে থাকে। এই উপসর্গগুলো ইনফেকশনের লক্ষণ। ৪. প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রস্রাব না করলে এবং প্রথম ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পায়খানা না করলে। ৫. কনজাংটিভাইটিস – শিশুর চোখ লাল হয়ে যাওয়া, সঙ্গে চোখে পিঁচুটি বা পুঁজ জমা হওয়া। স্ত্রীর রক্তের গ্রুপ নেগাটিভ এবং স্বামীর গ্রুপ পজিটিভ হলে গর্ভাবস্থায় চিকিৎসককে জানাতে হবে
যেসব উপসর্গ অসুখের পর্যায়ে পড়ে না এবং কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না, সেগুলো হলো, মিলিয়া: জন্মের কয়েকদিনের মধ্যে নাকে এবং মুখে সাদাটে গুটির মতো দেখা দেয়। ত্বকের ঘর্মগ্রন্থির মুখ সেবাম নিঃসরণ করে বন্ধ হয়ে গিয়ে এটি হয়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এটি ভালো হয়ে যায়। ইরাইথেমা টক্সিকাম নিওনেটারাম: সাধারণ মানুষ এটাকে মাসিপিসি বলে থাকে। জন্মের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনে মুখ, বুক এবং পিঠে লাল লাল দানার মতো এগুলো দেখা দেয়। সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে আপনা-আপনিই ভালো হয়ে যায়। ক্র্যাডেল ক্যাপ: নবজাতক শিশুদের মাথায় খুশকির মতো দেখতে প্রথমে লালচে তারপর হলদে বা বাদামী রঙয়ের তেলতেলে পুরু চামড়া জমতে থাকে। সাধারণত মাথায় বেশি হয় তবে ভ্রু, নাক, গলাতেও হতে পারে। । অনেক সময় বাজে গন্ধ হয়। এটি মায়ের থেকে পাওয়া হরমোনের প্রভাবে হয়ে থাকে। এ জন্য কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। এগুলো ৬ মাস বয়সের মধ্যে নিজে থেকেই ভালো হয়ে যায়। তবে মাথা ও চুল পরিষ্কার রাখতে হবে, নরম চিরুনি দিয়ে আস্তে আস্তে আঁচড়াতে হবে। এপস্টেইন পার্ল: মুক্তার মতো দেখতে এপিথেলিয়েল কোষের সমষ্টি মুখের ভেতরে তালুতে বা ছেলে শিশুদের জৌনাঙ্গের অগ্রভাগে থাকতে পারে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। নেটাল টিথ: আঞ্চলিক ভাষায় একে গর্ভদাঁত বলে। একে অশুভ ভাবার কোনো কারণ নেই। দুধদাঁত ওঠার আগে এটি ঝরে যায়। তবে যদি নড়তে থাকে কিংবা বুকের দুধ খেতে অসুবিধা হয় তাহলে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করে তুলে ফেলতে হবে। ফোলা স্তন: নবজাতকের ফোলা স্তন নিয়ে আমাদের দেশে অনেক কুসংস্কার আছে। প্রায়ই দেখা যায় এটাকে অভিশাপ হিসেবে দেখা হয় এবং দুধ বের করার চেষ্টা করা হয়। এতে করে স্তনের ইনফেকশন বা সেলুলাইটিসের প্রবণতা বেড়ে যায়। গর্ভাবস্থায় মায়ের কাছ থেকে পাওয়া হরমোনের প্রভাবে এটি ঘটে থাকে। এগুলোরও কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। যোনিপথে রক্তক্ষরণ এবং নিঃসরণ: গর্ভকালে মায়ের শরীর থেকে শিশুর শরীরে যাওয়া ইস্ট্রোজেন হরমোনের প্রভাবে মেয়ে নবজাতকের যোনিপথে মাসিক হওয়ার মতো রক্তক্ষরণ হতে পারে। এটি কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। কয়েক দিনের মধ্যেই এটি বন্ধ হয়ে যায়। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে এই হরমোনের প্রভাবে যোনিপথে সাদা ঘন পদার্থের নিঃসরণ ঘটতে পারে। এটিও আপনা থেকেই সেরে যায়। ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস: এটি নন–প্যাথোলজিক্যাল জন্ডিস। জন্মের তিন থেকে ছয় দিনের মধ্যে ৬০-৮০ শতাংশ নবজাতকের মধ্যে জন্ডিস দেখা দেয়। এই জন্ডিস মুখ, বুক, হাত এবং পেটের ত্বক পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। সাধারণত জন্মের সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। জন্ডিস ছাড়া শিশুর আর কোনো অসুবিধা থাকে না এবং প্রস্রাব, পায়খানার রং স্বাভাবিক থাকে। তবে এক্ষেত্রে কিছু উপসর্গ খেয়াল করতে হবে এবং সেগুলো থাকলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ১. জন্ডিস যদি পায়ের ত্বক এবং হাত কিংবা পায়ের তালু পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে ২. পায়খানার রং সাদা হলে ৩. ১৪ দিনের পরও জন্ডিস ভালো না হলে নাক বন্ধ এবং ঘড় ঘড় শব্দ: নবজাতকের নাক বন্ধ সমস্যা নিয়ে বাব-মা সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন থাকেন এবং এই কারণে সবচেয়ে বেশি পরামর্শ নিয়ে থাকেন চিকিৎসকদের। নাক বন্ধ থাকার কারণে পিঠে হাত দিয়ে কোলে নিলে এক ধরণের শব্দ অনুভব করেন তাঁরা। ছয় মাস বয়সের নিচের শিশুদের নাকের ভেতরের পর্দা খুব সহজেই ফুলে যায় এবং নাকের ভেতর মিউকাস জমতে থাকে। সেজন্য প্রায়শ নাক বন্ধ থাকে। নরসল (সোডিয়াম ক্লোরাইড) ড্রপ বার বার ব্যবহার করলে এই সমস্যা থেকে প্রতিকার পাওয়া যাবে। নবজাতকের পায়খানার সমস্যা: নবজাতক প্রতিদিন অনেকবার অল্প অল্প করে পানি পানি ছড়ার মতো হলুদ বা সবুজ পায়খানা করতে পারে। আবার কোনো কোনো নবজাতক প্রতিদিন পায়খানা করে না। যেসব নবজাতক শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ খেয়ে থাকে তাদের জন্য এটি স্বাভাবিক ব্যাপার এবং তিন থেকে সাত দিন পর পর যদি নরম পায়খানা হয় তাহলে উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে পায়খানা যদি শক্ত গুঠির মতো হয় তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। লেখক: স্পেশালিস্ট, পেডিয়াট্রিক আইসিইউ, এভারকেয়ার হাসপাতাল, ঢাকা
নিউজ ডেস্ক| দৈনিক আজবাংলা
|
ই-মেইল: ajbanglaonline@gmail.com
বাড়ি#৩৫/১০, রোড#১১, শেখেরটেক, ঢাকা ১২০৭